জণ্ডিসের রুগীকে গ্লুকোজ খাওয়ানোর দরকার আছে কি?

জণ্ডিসের রুগীকে গ্লুকোজ খাওয়ানোর দরকার আছে কি?



আপনি কি কখনও আপনার কোনো অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে গেছেন? ব্যাগে করে কী কী নিয়ে গেছেন? আমি অবশ্য না দেখেই তা বলে দিতে পারি। ভেবে বসবেন না যেন ম্যাজিক জানি। বলার চেষ্টা করছি ভুল হলে ক্ষমা ঘেন্না যা হোক একটা করে দেবেন।

বেদানা, আপেল, লেবু, কলা, হরলিকস্ অবশ্যই থাকবে। কারণ বাজারে দামে রাজার আসনে এরাই তো বিরাজ করেন। এতে রোগীরও মনের তুষ্টি, আর আত্মীয়ের জন্য খরচ করতে পেরে আপনারও মনের পুষ্টি। তবে এতে রোগীর পুষ্টি যে বিশেষ কিছু হয় না তা মাধ্যমিক পাশ একজন ছাত্রও জানে। ওগুলির চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর উপাদান আছে বেল, পেয়ারা, খেজুর, কাঁঠাল, তাল, আম, জাম। তবুও এরা রোগীর পথ্যে নেপথ্যেই থেকে গেছে। আর যেটা রোগীর সত্যি সত্যি পথ্যি হতে পারে সেই চাল,ডাল, তেল, চিনি, আটা, ডিম, সুজি নিয়ে রোগী দেখতে যাবার দুঃসাহস তো অতি বড়ো শিক্ষিতও (ডিগ্রীধারী নয়) দেখাতে পারবে না। এর উপর কেস যদি হয় জণ্ডিস তাহলে তো কথাই নেই। উপরের লিস্টিতে গ্লুকোজ বৃষ্টি হবেই। জণ্ডিসের রোগীকে গ্লুকোজ খাওয়ানোর পরামর্শ প্রায় সব ডাক্তারই (অল্প কিছু ভালো ডাক্তার বাদে) দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে দেশি ডিগ্রীধারী এবং বিলেতি ল্যাজুড়ধারী প্রায় সবারই এক রা। কেন সব ডাক্তারই জণ্ডিসে গ্লুকোজ খেতে বলেন? গ্লুকোজ কোম্পানি কী ডাক্তারদের বিক্রির উপর কমিশন দেন! দিতেও পারে! এদেশে তো কমিশন, কাটমানি, ঘুষ, দালালি, সেলামি কোনো অপরাধ নয় বরং যে যত বেশি পরের ধনে পোদ্দারি করে সে তত উঁচু পিঁড়িতে চড়ে।

আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারণা ছিল যে যার লিভারে যত বেশি গ্লাইকোজেন (শর্করা জাতীয় এক রাসায়নিক) থাকে তার লিভার তত বেশি শক্তিশালী এবং গ্লুকোজ থেকে বিপাকীয় ক্রিয়ায় লিভারে গ্লাইকোজেন তৈরি হয়। এই যুক্তি থেকেই সম্ভবত লিভারের অসুখে গ্লুকোজ খাওয়ানোর চল চালু হয়েছিল। পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু ঐধারণার সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও কুসংস্কারটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। জণ্ডিস হলে রোগীকে গ্লুকোজ খেতে হবে একথা ডাক্তারবাবুরা চিকিৎসা শাস্তে্রর কোনো বইতে দেখাতে পারবেন না। অনেকে বলেন খেলে কোনো ক্ষতি তো নেই তাহলে খেতে দোষ কী?

কেন মিছিমিছি টাকার অপচয় ক্ষতি নয়? আসুন ক্ষতির বহরটা একটু হিসাব করা যাক। বাজারে গ্লুকোজ যে নামে বেশি বিক্রি হয় তা হল গ্লুকন ডি। ১০০ গ্রাম গ্লুকন ডি-র দাম ২২ টাকা। দৈনিক ১০০ গ্রাম করে গ্লুকোজ খাওয়ালে ১৫ দিনের জন্য খরচ পডে় ৩৩০ টাকা। ১৩০কোটির দেশ ভারতবর্ষে শতকরা একজনেরও বছরে একবার জণ্ডিস হলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১.৩ কোটিতে। এদের আবার অর্ধেক জনেরও গ্লুকোজ কেনার পয়সা জুটলে শুধু ভারতে গ্লাক্সো কোম্পানির গ্লুকোজ বিক্রি দাঁড়ায় ২১৫ কোটি টাকার। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা পয়সা ওরা রোজ এমনি করে ডাক্তারদের কারসাজিতে ডাকাতি করে চলেছে। এছাড়া গ্লুকোজ বেশি খেলে পেট ফাঁপা, পাতলা পায়খানা এসবও হয়। আর ডায়াবেটিস রোগীদের গ্লুকোজ যে মৃত্যুরই পরোয়ানা তা কে না জানে?

এরপরও যদি কারো গ্লুকোজকে ভালো মনে হয় তাহলে তিনি রোগীকে চিনি খেতে বলতে পারেন। হ্যাঁ সেই চিনি, যাকে আপনি-আমি সবাই চিনি। কেন চিনি? কারণ চিনি হল শর্করা জাতীয় খাবার। আর সমস্ত শর্করা জাতীয় খাবারই আমাদের পরিপাক তন্তে্র ভেঙে শেষ পর্যন্ত গ্লুকোজ তৈরি হয়। চিনিও আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের ঝিল্লিতে ডাইস্যাকারাইডেজ্ নামে এক উৎসেচকের প্রভাবে ভেঙে গিয়ে গ্লুকোজ তৈরি হয়। প্রতি ২ গ্রাম চিনি থেকে ১ গ্রামেরও বেশি গ্লুকোজ তৈরি হয়। ১ কেজি চিনি থেকে ৫২৭ গ্রাম গ্লুকোজ পাওয়া যায়। তাহলে ১০০ গ্রাম গ্লুকোজের জন্য ২০০ গ্রাম চিনি লাগবে। যার দাম পড়বে ৬ টাকা। অর্থাৎ ২২ টাকার গ্লুকন-ডির কাজ উসুল করতে মাত্র ৬ টাকার চিনি মাশুল। চিনিকেও বেশ অচেনা লাগছে না। এছাড়া গ্লুকন ডি-এর শরবত আর চিনির শরবৎ দুইয়ের মধ্যে কে বেশি সুস্বাদু। ভোটাভোটি করবেন নাকি?

@বরুণ ঘোষ