ডুমুর ফুল
*************************************
ডুমুর ফল আমরা অনেকেই খেয়েছি কিন্তু ডুমুরের ফুল দেখেছেন কখনও? না ?
না, আমি কেনো কেউই দেখেন নি।
ডুমুর ফল প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। এর ফুল আসলে হয় ফলের ভেতরে! মানে ডুমুর ফল যেটাকে বলে সেই ফলের বাইরের আবরণের ভেতরে থাকে সব ফুল। 
মানে ডুমুর ফুলকে বাইরে থেকে কখনও দেখা যায় না। এখন প্রশ্ন, যদি সব ফুল ভেতরেই থাকে, এই ফুলে তাহলে পরাগায়ন হয় কিভাবে? কারণ পরাগায়ন ছাড়া তো বংশবৃদ্ধি সম্ভব না।
.
ডুমুর ফল দুই ধরনের হয় - পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ। পুং ফলের ভেতরে পুং ফুলের মধ্যে থাকে পরাগরেণু যেটাকে কোনভাবে পৌঁছাতে হবে স্ত্রী ফুল পর্যন্ত। এক ফলের ভেতর থেকে আরেক ফলের ভেতরে।

 না কোন প্রজাপতি এই কাজ করতে পারবে, না কোন পাখি, না ভ্রমর বা অন্য কোন পতঙ্গ। এই কাজের জন্য আসলে প্রকৃতিতে নিয়োজিত আছে এক বিশেষ ধরনের পতঙ্গ। একে বলা হয় ডুমুরের পোকা (Fig Wasp)। 
 প্রকৃতি যেন এই পোকাকে তৈরিই করেছে ডুমুর গাছের জন্য। ডুমুর ফলের নিচের দিকে ছোট্ট একটা ছিদ্র থাকে, যেই ছিদ্র দিয়ে ডুমুর পোকা ফলের ভেতরে ঢুকতে পারে। আর এখানেই শুরু হয় জীবন মরণের সব খেলা।

এই পোকারা ডুমুর গাছেই থাকে। এরা আর্থোপোডা পর্বের প্রাণী। এই পোকা ডিম পাড়ার জন্য পুং ডুমুর ফল খোঁজে, কারণ পুং ফলের ভেতরের অবস্থা এই পোকার ডিম পাড়ার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী যায়গা। ডুমুরের ফল যখন সুগঠিত হয়নি তখন এই পোকাগুলো ডিম পাড়ার জন্য ফলের নিচের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু এই ছিদ্র খুবই ছোট, এর ভেতর দিয়ে কষ্ট করে ঢোকার সময় ডুমুর পোকার দেহের নানা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাখা ঝড়ে পড়ে। একবার কষ্ট করে ভেতরে পৌঁছে গেলে এরা সেখানে ডিম পাড়ে আর তার জীবনের উদ্দেশ্য শেষ হয়, সে মারা যায়। ডিম থেকে পোকার লার্ভা জন্ম গ্রহণ করে আর এরা যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষম হলে ছেলে পোকা আর মেয়ে পোকার মধ্যে মিলন ঘটে। জন্মের পরে প্রথম কাজ তাদের এটা। মানে ফলের ভেতরে জন্মগ্রহণ করা মেয়ে পোকাগুলো ফল থেকে বের হওয়ার আগেই প্রেগনেন্ট হয়ে যায়। এই স্টেজ সম্পূর্ণ হলে ছেলে পোকাগুলো সবাই মিলে ফল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাস্তা খুঁড়তে থাকে। আসলে এরা রাস্তা বানায় মেয়ে সঙ্গীগুলোর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। ছেলে পোকাগুলোর পাখা নেই, এরা দেখতেও পায়না, আবার এই সুরঙ্গ খোড়ার সময় অনেকে আহত হয়। তো এই খোঁড়াখুড়ি শেষ হলে অনেক ছেলে পোকাই মারা যায়, বা যারা বেঁচে থাকে তারা গাছে বাস করে, এগুলো আর কোন কাজে আসে না। কিন্তু এদের খোঁড়া সেই সুরঙ্গ দিয়ে প্রেগনেন্ট মেয়ে পোকাগুলো পুং ফুলের পরাগরেণু গায়ে, পাখায় লাগিয়ে বেরিয়ে আসে। 

এই স্ত্রী পোকাগুলো এখন নতুন ফল খোঁজে ডিম পাড়ার জন্য। আর এই পোকাগুলো যখন ডিম পাড়ার জন্য একটা স্ত্রী ফুলে প্রবেশ করে তখন ফুলের পরাগায়ন সম্পন্ন হয়। কিন্তু স্ত্রী ফলের ভেতরের আবহাওয়া পোকার বা ডিমের জন্য অনুকূল না। তো কোন প্রেগনেন্ট পোকা স্ত্রী ডুমুর ফলে প্রবেশ করলে এর মৃত্যু ঘটে, পুং ফল ছাড়া এরা বাঁচতে পারে না। স্ত্রী ফলের ভেতরে স্ত্রী পোকার মৃত্যু হলে ডুমুর ফল এক ধরনের এনজাইম নির্গত করে যা পোকার মৃতদেহকে নষ্ট করে দেয়। 

তার মানে ডুমুর গাছের বংশবৃদ্ধির জন্য আসলে দরকার স্ত্রী পোকা যেন ঢুকে স্ত্রী ফুলে, কিন্তু স্ত্রী পোকার বংশবৃদ্ধির জন্য ঢোকা দরকার পুং ফুলে।  এই সমস্যার সমাধানও প্রকৃতি নিজেই করে নিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ডূমুর গাছ এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে এর পুং আর স্ত্রী ফল দেখতে একই রকম, পোকা যেন বাইরে থেকে দেখে কোনভাবে বুঝতে না পারে যে ভেতরে পুং ফুল না স্ত্রী ফুল আছে। ভেতর পর্যন্ত যাওয়ার আগে কোন প্রেগনেন্ট পোকা বুঝতেই পারে না যে সে কার ভেতরে ঢুকছে। 
পোকার সততা আর গাছের প্রতারণা! কিছু পোকা পুং ফুলে ঢোকে, কিছু পোকা স্ত্রী ফলে, আর গাছ-পোকার এই চক্র চলতে থাকে। এক গবেষণায় তো এটাও দেখা যায় যে ডুমুর পোকা যদি যথেষ্ট পরিমাণ স্ত্রী ফলে না ঢুকে পুং ফলে ঢোকে তাহলে গাছ সেই ফলগুলো দ্রুত ঝড়ে ফেলে দেয়, যাতে গাছের বংশবৃদ্ধি না হওয়ায় পোকারও বংশবৃদ্ধি না হয়, গাছের প্রতিশোধ!

এই হল ডুমুর ফুলের ইউনিক পরাগায়নের সিস্টেম।

তথ্যসূত্রঃ
Fig wasp | insect | Britannica
BBC - Earth - A tale of loyalty and betrayal, starring figs and wasps
Study: Trees retaliate when fig wasps don't service them | Cornell Chronicle