কৃত্রিম ত্বক - বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং




জৈব প্রযুক্তিবিদ্যার মানে ইংরেজিতে যাকে বলে বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং, জগতে আপনি স্বাগত!এ এক অন্য দুনিয়া তৈরী হচ্ছে,অজস্র মানুষের এতদিনের নানান শরীরভিত্তিক সমস্যা মিটিয়ে দিতে এই বিদ্যা বা এর সংশ্লিষ্ট মানুষরা অসামান্য এক দুনিয়া তৈরী করবে আগামীতে।মানুষ সত্যই হবে অমৃতের পুত্র বা কন্যা।আমি গর্বিত এবং আনন্দিত এই জন্য যে আজকে যে খবর আপনাদের সামনে তুলে ধরবো তার কাজের কান্ডারি একজন প্রবাসী ভারতীয়।আমরা এখনো গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলো অনাদরে ফেলে রেখেছি তাই এই মানুষগুলো কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বের নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে হয়।চিন্তা করবেন না,আগামীতে আমরাও এই পথেই যাবো।যাইহোক বড় বাজে বকে ফেললাম,আসুন মূল বিষয়ে যাই।

চারিদিকে নানান কারণে দুর্ঘটনায় অসংখ্য দুর্ভাগা মানুষের ত্বকের ক্ষতি হয়।শরীরে একটা বাহ্যিক ক্ষতি তো আছেই এর উপরে আছে অশেষ যন্ত্রনা।খালি ভাবুন তো আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা!এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে,দিন বদলের সেই মহেন্দ্রক্ষণ এসেছে আজ।তৈরী হতে চলেছে এক কৃত্রিম চামড়া যা স্বাভাবিক চামড়ার পরিপূরক হয়ে উঠবে।দশকের পর দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই আবিষ্কার আর এটিকে সফল করেছে সেই এই শতকের এক মহা আবিষ্কার ত্রিমাত্রিক মুদ্রক বা থ্রি ডি প্রিন্টার।অতীব কঠিন একটি কাজ এই কৃত্রিম চামড়া তৈরী করা।কারন এর সাথে যে যোগ করতে হয় কার্যকরী রক্ত সংবাহক নালিকা !
এই গবেষণা বা সফলতা এসেছে রেন্সেলার(Rensselaer)পলিটেকনিক সংস্থা এবং ইয়েল(Yale) বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে জীবন্ত মানুষের ত্বকের কোষকে সফলতার সাথে জৈব কালি তে রূপান্তর করতে পেরেছে।এই জৈব কালি দিয়ে আক্ষরিক অর্থে কৃত্রিম চামড়া ছাপানো সম্ভব হয়েছে,হ্যা সঙ্গে নিজস্ব রক্ত জালিকা ব্যবস্থা সমেত!

এই সংযোজন হলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এই কাজ সফলতার সাথে করার কান্ডারি পঙ্কজ কারান্ডে ,একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী পেশায় Rensselaer পলিটেকনিক সংস্থার রাসায়নিক এবং জৈব প্রকৌশলের অধ্যাপক যিনি এই পুরো গবেষণা কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।তার মতে এই কাজে আসল সোপান ছিল গ্রহীতার শরীরের সাথে এই প্রতিস্থাপিত ত্বকের সংযোগ করানো।মাথায় রাখবেন,বাইরের কোনো জৈব বস্তু আপনি চাইলেও শরীরে প্রবেশ করাতে পারবেন না।শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ওটাকে নষ্ট করে দিতে পারে বা পুরো শরীরের নানান ক্ষতির কারন হতে পারে।
আজকে কোনো ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য এই ত্বকের সংযোজন হয় দু ভাবে, এক ওই মানুষটির নিজের শরীরের থেকে মানে অন্য জায়গার ত্বক কে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জায়গায় লাগানো আর দ্বিতীয় হলো নানান গবাদি পশুর শরীর থেকে পাওয়া বিশেষ একটি প্রোটিন bovine collagen কে দিয়ে কাজ চালানো অথবা বিশেষ শরীরের উপযোগী পলিমার ফোম দিয়ে কাজ চালানো।প্রথমটি যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক আর নতুন ক্ষতের কারন ও হতে পারে আর দ্বিতীয়টি একটি সাময়িক ব্যবস্থা যা দিয়ে গভীর ক্ষতের পূরণ হয় না বা মানব ত্বকের মতো দেখতেও হয় না।অনেকটাই আমাদের পরিচিত ক্ষতের উপরের ব্যান্ডেজ বা পরিচিত ব্যান্ড এড গোছের একটা আস্তরণ দেয়।এই দুই ক্ষেত্রেই যা হয় না তা হলো মানব শরীরের ত্বকের স্বাস্থ ঠিক রাখতে রক্তের মাধ্যমে যে পুষ্টি আসার দরকার তা তো আসে না।এ ছাড়া আমাদের শরীরের বর্জ্য বস্তু ঘামের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় এই ত্বকের উপরের অংশ দিয়েই,তাও হতে পারে না।সব মিলিয়ে আজকের ব্যবস্থা মোটেই একটি সঠিক সমাধান না।

এর সমাধানে ডক্টর কারান্ডের নেতৃত্বে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার দল মানব নাভির সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে বিশেষ এন্ডোথেলিয়াল কোষ সংগ্রহ করেন।এই গুলো কোষ তৈরির সহায়ক বস্তু আর বিশেষ মানব প্যাসেন্টাল কলার সৃষ্টির কোষ সংগ্রহ করেন।এরপরে এটি পরীক্ষাগারের ইদুরের লেজের অংশের চামড়ার উপরে প্রতিস্থাপিত করেন বিশেষ মুদ্রণ ব্যবস্থায়।এই প্রতিস্থাপনের ভিতরের স্তর বা ডার্মিস এ উপরের সেই কোষের অবস্থান রাখা হয়।দ্বিতীয় আরো একটি জৈব কালি যা মানুষের চামড়ার উপরিভাগের ত্বকের কোষ দিয়ে তৈরী হয়।এটি কেরাটিনোসাইটস (keratinocytes) নামের কোষ দিয়ে উপরের ত্বকের অংশ বা এপিডার্মিস সৃষ্টি করে।এই তৈরির পরে গবেষণাগারের বিশেষ কোষ আধার এ এই এন্ডোথেলিয়াল আর প্ল্যাসেন্টাল পেরিসাইটস বস্তু একটি একীভূত হওয়ার মাধ্যমে সূক্ষ্ম রক্ত জালিকার যোগাযোগের বস্তু তৈরী হয়।সোজা ভাষায় একটি সজীব ত্বক তৈরী হয়ে যায় প্রতিস্থাপনের জন্য।এরপরে এই জৈব ত্বক প্রতিস্থাপন হয় ইঁদুরদের শরীরে।অতীব আনন্দের খবর এই যে প্রস্তুত করা সেই রক্তজালিকা সমেত এই ত্বক ইঁদুরগুলোর শরীরের নিজস্ব রক্ত বহনকারী মানে সংযোগকারী জালিকার সাথে মিশে গিয়েছে চার সপ্তাহের মধ্যেই।মানে ওই প্রতিস্থাপিত চামড়ার মধ্যে ইঁদুরগুলোর শরীরের রক্ত পরিবহন চালু হয়ে যায়।কারান্ডে বলেছেন এই প্রতিস্থাপন একদম আমাদের শরীরে যে ভাবে ত্বকের ক্ষতির পরে তা সুস্থ ত্বকের তৈরির পরে যে রকম হয় তাই হয়েছিল।
যাত্রা এখনো শেষ হয় নি :
এই গবেষক দলকে এখন তৈরী করতে হবে প্রস্তুত করা যায় ও রকম জৈব বস্তু দিয়ে এই ত্বকের মূল উপাদান খুঁজে নেওয়া যা মানুষের শরীরের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।কারন এই উপরে বলা ইঁদুরদের উপর প্রতিস্থাপন করার সময়ে তাদের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল তা তো মানুষের জন্য করা বেশ ঝুঁকির হবে।এই ক্ষেত্রে সাহায্য নেওয়ার জন্য ভাবা হচ্ছে জীন সম্পাদনার প্রযুক্তি কে যা দিয়ে আগেই শরীর কে ছিনিয়ে দেওয়া হবে এই বাইরের থেকে প্রতিস্থাপিত ত্বকের বা একটি উপযোগী নির্দেশ জুড়ে দেওয়া যাবে।প্রসঙ্গত বলা যায় ওটা আজ করা সম্ভব কিন্তু !
এছাড়া আরো একটা বিষয় আছে,আমাদের ভৌগোলিক অঞ্চল ভেদে নানান জায়গার মানুষের চামড়ার রং ভিন্ন। একজন এশিয় বিশেষত ভারতীয় কোনো মানুষের চামড়ার ক্ষেত্রে কখনোই একজন ইউরোপীয় মানুষের চামড়ার রং মিলবে না। ডক্টর কারান্ডে এবং তার দল ওটার সমাধান করেছেন,আমাদের শরীরের মানে ত্বকের একটি উপাদান মেলানোসাইটিস এর কম বেশি তে এই রঙের পার্থক্য হয় তাই বেশি মিশিয়ে কালো রঙের ত্বক আর কম দিয়ে ধলা ত্বক তৈরীর কাজটির সমাধান তারা কিন্তু করে ফেলেছেন।
সম্পর্কিত আরো কিছু লেখায় এই কাজের ভূয়সী প্রসংশা দেখছি।অনেকেই এই কাজকে একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বলে অবিহিত করেছেন।হয়তো আগামীর দিনগুলো এই পুড়ে যাওয়া বা নানান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ গুলো বা কিছু নরপশুর কারণে নিরীহ সব মহিলাদের এসিড নিক্ষেপ করে জীবন দুর্বিসহ করে দেওয়ার নারকীয় কাজের জীবন থেকে মুক্তি পাবে অসংখ্য মানুষ।
এই সফলতার পরে পর্যায় ক্রমে একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে এর সফলতার উপরে।এই জৈব ত্বক ঘর্ম গ্রন্থি এবং দেহের রঙের নিয়ন্ত্রক অংশর সফলতার হেরফের হলেও তার সফলতা পাওয়া গিয়েছে।আগামীতে হাসপাতাল গুলো নিশ্চিত ভাবে নতুন ব্যবস্থা বা এই প্রতিস্থাপকের জন্য নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। দরকার হবে প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগ তবে তা খুব একটা বড় সমস্যা হবে না।প্রযুক্তির প্রবেশ আর তার ক্রমাগত উৎপাদন ক্রমশ তার দাম আয়ত্বে নিয়ে আসে।সব মিলিয়ে আমি এটি পুরোপুরি সম্ভব বলেই দেখতে পাচ্ছি।
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম।পাঠক,বিশ্বাস না,নিশ্চিত প্রত্যয় থেকেই বলছি আগামীর দিন গুলো খুব সুন্দর হতে চলেছে।ভরসা রাখুন বিজ্ঞানে।ভরসা রাখুন আগামীর মানুষের ধীশক্তির উপরে।জয়তু বিজ্ঞান! জয়তু মানব প্রজ্ঞা!