ব্লু টুথ বা নীল দন্তের মহিমা কথা...


আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে বহু ধরণের ব্যবস্থা এসেছে বা আসবে।অনেক কিছু আজ বাতিল হলেও এই ব্লু টুথ সংযোগ কিন্তু প্রায় দুই দশক ধরে আমাদের কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয়।আসুন এক সাথে জানি এর বিষয়ে কিছু কথা।লেখাটি সর্বজনীন করার তাগিদে কঠিন সব বস্তু বর্জন করে আমাদের সাধারণের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি।পরবর্তী পর্বে ওয়াই ফাই বা বৃহত্তর এক বেতার অন্তর্জালের প্রযুক্তি নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করবো।
এই জানার আগে আসুন জানি কি ভাবে এই ব্লু টুথ নামটি এলো।মজার হলো এই নামটি কোনো প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ত কিছু না।ডেনমার্কের এক রাজা যার নাম হেরাল্ড ব্লুটুথ গ্রূসাম, তার ডাকনাম ধরে এই এই নাম হয়েছে।এই লোকটি ডেনমার্ক এবং নরওয়ের এক অংশ কে একত্রে একটি অখন্ডতা দিয়েছিল।একই সাথে পরিবার মানে তার বাবা এবং মা কে সম্মান দিয়ে একটি ভিন্ন শ্রদ্ধার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল।কেন তার নাম এই নীল দন্তি বা নীল দাঁত তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই তবে একটা ব্যাখ্যা হলো রাজা ব্লু বেরি খেতে ভালোবাসতো আরো একটি বাখ্যা হলো রাজার সামনের একটি দাঁত নষ্ট হয়ে রং ঐরকম হয়েছিল।তা সে যাই হোক, ১৯৯৭ এ ইন্টেল কোম্পানির জিম কার্ডাস আর এরিকসনের ম্যাটিসন একটি পানশালাতে বসে আলাপ করতে গিয়ে ম্যাটিসন এই নামটি প্রস্তাব করে আর তা পরবর্তিতে এই স্ক্যান্ডেনেভিয়ার কোম্পানিগুলো নিজেদের অঞ্চল বা স্বদেশের প্রতি অতীব ভালোবাসা থেকে এই বস্তুটির নামকরণ করে রাজার নামে।সমস্যা হলো আমাদের এই ভালোবাসা দেখালেই আপনি আবার আলোকপ্রাপ্ত থাকেন না।যাইহোক বেলাইনে যাচ্ছিলাম আবার বিষয়ে আসি।এই পথে ১৯৯৮ এ তৈরী হয় বিশেষ স্বার্থ গোষ্ঠী মানে এই কাজে একত্রে নোকিয়া ,এরিকসন,তোশিবা,আইবিএম,ইন্টেল মিলে একটি যৌথ বিনিয়োগ করে এই কাজ শুরু করে।নাম হয় স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রূপ।এর পরে প্রবল জনপ্রিয়তা আর আজকের প্রসার তো আমাদের সবার সামনেই হয়েছে।
যেমন বলেছি, এই ব্লুটুথ একটি সর্বাধিক জনপ্রিয় বেতার সংযোগ ব্যবস্থা।আজকে গৃহস্থলীর নানান সরঞ্জাম যেমন ধরুন গান শোনার যন্ত্র বা মুঠোফোন অথবা আপনার কম্পিউটারের মাউস থেকে কি-বোর্ড,গাড়ির নানান সুরক্ষা বা অন্য প্রাসঙ্গিক বস্তুর সাথে সংযোগ করে কাজ করতে এর জুড়ি নেই।
দুটি বৈদ্যুতিন বস্তুর যোগসাধনের জন্য কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়।প্রাথমিক স্তরে আপনাকে এমন সংযোগ ভাবতে হবে যাতে আপনি দুটি বস্তুর সংযোগে যে বার্তা বিনিময় হচ্ছে তা কতটুকু আর তার সঠিকতা থাকছে কি না তার নির্নয় করবেন।সোজা কথায় এই যোগাযোগ সেই কম্পিউটারের মতো শূন্য এবং এক দিয়ে বুঝানো বাইনারি পদ্ধতি।খটকা লাগে? বেশ সহজ বস্তু হলো আপনি যা কিছু যোগাযোগের মাধ্যমে করছেন তা সবই কিছু নির্দেশ আর তার বোঝার উপায়।যত জটিল আপনার নির্দেশ তত বেশি তথ্যের সম্ভার চলাচল করার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
আসুন জানি এই ব্লু টুথ কি ভাবে এই সংযোগ তৈরী করে
এর আগে বলে রাখি, এই বস্তুটি গ্রাহকের বারবার যোগাযোগের শ্রম দূর করে অতীব কম বিদ্যুৎ খরচে একটি স্থানীয় মানে স্বল্প দূরত্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরী করে।এটি মূলত দুটি স্তরের একটি ব্যবস্থা।প্রথমটি হলো বাহ্যিক বা বস্তুগত একটি স্তর যার মাধ্যম দুটি জিনিস একটি গ্রাহক আর অপরটি প্রেরক।এই আদানপ্রদানের মাধ্যম যা আগে বলেছি,বেতারের একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক।এর সুবিধে হলো এটি অতীব কম খরচে হয় আর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়।
সস্তার অন্য যা বেতার সংযোগ দেখেন তার একটি হলো অবলোহিত রশ্মির সংযোগ বা ইনফ্রা রেড যোগাযোগ,ঝামেলা হলো এটি আমাদের দৃষ্টিগোচর না হলেও এর যোগাযোগ করার জন্য দুটি যোগাযোগের বস্তুর মধ্যে একটা পারস্পরিক দৃশ্যমান হওয়ার ঝামেলা থাকে।একটু ঝামেলা লাগছে বুঝতে? আরে,আপনার টিভির রিমোটের কথা বলছি!হ্যা,টিভির এবং রিমোটের মধ্যে আলোক সংযোগ না থাকলে আপনি রিমোট টিপলেই কি টিভি কাজ করে? অথচ স্নান ঘরে বসে এই ব্লু টুথ কোনো বস্তুর সাথে আপনি যোগাযোগ করতেই পারেন। তফাৎ ঐখানেই!আরো যা পারেন তা হলো এই ব্লু টুথ দিয়ে একাধিক বস্তুর সংযোগ সাধন করতে যা টিভির রিমোট মানে ওই ইনফ্রারেড সংযোগে পারেন না।
কি করে কাজ করে এই ব্লু টুথ ?
এই ব্লুটুথ যোগাযোগ রাখে একটি নির্দিষ্ট বেতার কম্পাঙ্কে।এটি গোদা হিসেবে ২.৪৫ গিগাহার্টজ বা আরো একটু নির্দিষ্ট ভাবে বললে ২.৪০০ থেকে ২.৪৮৩ গিগাহার্টজ এর মধ্যে এই সংযোগের কাজ চলে।এই কম্পাঙ্ক এক বড় বিষয়,মানে আগেই আন্তর্জাতিক স্তরে নির্ধারিত কোন কম্পাঙ্ক কি কাজে লাগবে তার ভিত্তিতে ওটা স্থির করা।এই যেমন আজকাল ব্যান্ড উইড্থ বিক্রির কথা শোনেন কোনো দূরাভাষের নতুন প্রযুক্তি এলে (ফোর জি /থ্রি জি ইত্যাদি)ওই গুলো বা অন্য সব যন্ত্র কিন্তু বিভাগ অনুযায়ী আলাদা আলাদা কম্পাঙ্কে কাজ করে এবং তা পৃথিবীর সর্বত্র একই ভাবে করে থাকে।আগের ফাইভ জি নিয়ে লেখাতে একটু ছুঁয়ে গিয়েছি।পরবর্তীতে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে,আপাতত মূল বিষয়ে ফিরে যাই।
এই ব্লু টুথ প্রযুক্তির নিরিখে আপনি এই সংযোগের সর্বোচ্চ সীমা এক কিলোমিটার মানে ৩২৮১ ফিট পর্যন্ত করতে পারেন।তাত্বিক সীমা যাই হোক,এই ব্লু টুথ অন্য কোনো যন্ত্রের একই ব্লু টুথ এর কোনো সংযোগের থেকে নিজের যোগাযোগ ব্যাহত না করতে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের যোগাযোগ করে।অতি দুর্বল এক বেতার সংযোগ করা হয় ইচ্ছাকৃত ভাবেই যার ফলে বাজারে যা কিছু এই ধরণের যন্ত্র দেখেন তার যোগাযোগ সীমিত থাকে ২০০ মিটার মানে ৬৫৬ ফিটের দূরত্বে।দুর্বল হয় দূরত্বের কম করতে তবে যেমন উপরে বললাম,আপনার সংযোগের যন্ত্র গুলোর মধ্যে কোনো দেওয়াল বা অন্য বাহ্যিক বাধা এতে কোনো অসুবিধের কারন হয় না।একই ভাবে একাধিক সংযোগের একটি সূত্রে ১০ মিটারের মানে ৩২ ফিট বৃত্তে এই যোগাযোগ রাখার কাজ করতে স্বক্ষম ব্লু টুথ।
এর আরো একটি মজা হলো, ওই উপরের বলা সংযোগের জন্য একটা অসাধারন পদ্ধতি নেওয়া হয়।ব্লুটুথ ওই সংযোগের সময়ে বেতার তরঙ্গের সংযোগ পাল্টে পাল্টে যোগাযোগ রাখতে থাকে।অকল্পনীয় ১৬০০ বার প্রতি সেকেন্ডে এই কম্পাঙ্কের নানান স্তরে নিজেকে পরিবর্তিত করতে থাকে।এই কাজ স্বয়ংক্রিয় মানে নিজে নিজেই হতে থাকে আর এর ফলে একাধিক ব্লু টুথ একই জায়গায় আলাদা আলাদা যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে পারস্পরিক কোনো বাধার সম্মুখীন হয় না।আর যদিবা কচিৎ কদাচিৎ হয়েও যায় তার স্থায়িত্ব এক অতীব অকল্পনীয় কম ন্যানো সেকেন্ড মানে ভগ্নাংশের সামান্য কিছু হয় এক সেকেন্ডের ফলে আপনি তা বুঝতেও পারবেন না।
এই ব্লুটুথ যোগাযোগে স্বক্ষম যন্ত্র গুলো যখন পারস্পরিক একটা যোগাযোগের সীমার মধ্যে আসে তখনই কিন্তু যোগাযোগ শুরু হয়ে যায় না।যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক হলে এর ব্যবহারকারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতি নেওয়ার কাজ করে নিতে হয়।সম্মতি দিলেই তবে যোগাযোগ শুরু তাই চাইলেই যোগাযোগ করা যায় না। এরপরে এই দুই বা একাধিক সংযোগকারী কে নিয়ে তৈরী হয় একটি ব্যক্তি কেন্দ্রিক সংযোগ সূত্র বা পার্সোনাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বা প্যান।এরপরে একাধিক ব্যবহারকারী নানান সংযোগের মাধ্যমে এই যোগাযোগ শুরু করে।একটা সহজ উদাহরণ হলো বেতার হেডফোন দিয়ে আপনি গান শুনছেন আবার সেই আপনি বেতার মাউস এবং কি বোর্ড দিয়ে কিছু লিখছেন বা খোঁচাচ্ছেন এই রকম একটি একক ব্যক্তির নানান সংযোগের একটি ছোট্ট নেটওয়ার্ক।একই সাথে আপনার মোবাইলের ব্লু টুথ দিয়ে অন্য পরিজনের সাথে ইন্টারনেট ভাগাভাগি করছেন অথচ প্রত্যেকটি কাজ আলাদা আলাদা।
বিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অসম্ভব বেশি হয়েছে হালের দিনগুলোতে,শ্রবন প্রতিবন্ধীর জন্য বিশেষ শ্রবন যন্ত্র থেকে শারীরিক পরীক্ষার নানান যন্ত্রে এর ব্যবহার তো আছেই,এর সাথে মহাকাশ প্রযুক্তির নানান যন্ত্র বা অসংখ্য সংযোগের কাজ করছে এই ব্লু টুথ যার উপরে লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে বলে ক্ষান্তি দিলাম।
ব্লুটুথ এর তথ্য বিনিময়ের সুরক্ষা :
উপরে যেমন বলেছি, আপনি চাইলেই কোনো ব্লু টুথ সংযোগে ঢুকে যেতে পারবেন না।যে কটি এই ধরণের যন্ত্র নির্মাণ হয় তার প্রত্যেকটিতে একটি ধর্ম জুড়ে দেওয়া হয়।না কোনো প্রচলিত ধর্ম না, এটি ওই ব্লু টুথ যোগাযোগের একটা নিয়ম ভাবতে পারেন।এতে একটি নির্দেশাবলী বা সফ্টওয়ার জুড়ে দেওয়া হয় যা বিশ্বাসযোগ্য বিনিময় যন্ত্রের একটি ছাঁকনি বা সতর্কতা আগেই নিয়ে থাকে।অর্থাৎ এই সংযোগে একটা অনুমতির বিষয় থাকে যা ধরে ট্রাস্টেড ডিভাইস বা বিশ্বস্ত যন্ত্রের তালিকা এই যন্ত্র নিজের স্মৃতিতে রাখে সর্বদা। অর্থাৎ পরিচিত যন্ত্রের বাইরে কোনো অন্য কিছু এতে যোগ দিতে পারে না।একই সাথে অনুমতি দেওয়া বা কটি কে সংযোগে নেওয়া হচ্ছে তার একটা নিয়ন্ত্রণ রাখা হয় ব্যবহারকারীর জন্য।
আগের দশক পর্যন্ত অবশ্য একটা ব্লুটুথ মাধ্যম ধরে ঢুকে যাওয়ার দরজা থেকে গিয়েছিল যা ধরে কিছু কুবুদ্ধি সম্পন্ন লোক ভাইরাস ছড়ানোর জন্য ওই ব্লু টুথ ধরে আপনার আগের মোবাইল গুলোতে ঢুকে যেতে পারতো তবে হালে মানে গত দশকেই ওই অনুমতি দেওয়ার বিষয় এসে যাওয়ায় এর অবসান হয়েছে ভাবা যেতে পারে।আপনি একান্ত নিজের সর্বনাশ না চাইলে কেউ ঢুকে গিয়ে মানে ওই ব্লু টুথ দিয়ে এসে আপনার যন্ত্র বিশেষত মোবাইল বা কম্পিউটার ইত্যাদিতে নিজে নিজেই কোনো কিছু সর্বনাশ করতে পারবে না।
পুরা হইলো না। সম্পূর্ণ হইলো না ....
তবে কি এই ব্লু টুথ নিশ্ছিদ্র? না, মানুষ নিরাপত্তা বানায় আবার মানুষই এর বলয় ভেঙে ফেলে।এই ব্লুটুথ সংযোগের নানান মাধ্যম বিশেষত চার চাকার গাড়ির নিরাপত্তা বা তার ভিতরের ব্লু টুথ দিয়ে চলা গান বা অন্য যন্ত্রাংশের সংযোগের জন্য প্রস্তুতকারক নির্দিষ্ট সংকেত মানে নিরাপত্তার কিছু নম্বর ইত্যাদি ক্রেতা কে দিয়ে দেয়।অনেক সময় সর্ষে তে ভুত বা বিশেষ হ্যাকার তার নিজস্ব ব্লু টুথ দিয়ে কোনো মিথ্যে বার্তা পাঠিয়ে দিতে পারে ওই গাড়ি বা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রের গ্রাহক বস্তুর কাছে। হ্যাকার বা এই বলয় ভাঙ্গার লোকেদের সুবিধে হয় কারন এই গাড়ি গুলো ব্লুটুথ ব্যবস্থার নিরাপত্তা চাবি সাধারনত হয় খুব সহজ সব সংখ্যা আর গাড়ি ধরে আলাদা আলাদা হয় না ফলে ওটা জেনে নেওয়া কোনো বড় বিষয় না।
এই সমস্যা গুলো কে ব্লু জ্যাকিং বা ব্লু বাগিং বলা হয়।সমস্যা ধরে আবার প্রস্তুতকারক তার ওই যন্ত্রের সফটওয়ারে পরিবর্ধন করে এর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে যেমন ভাবে আপনার অন্য এন্টি ভাইরাস নিজেকে সুরক্ষিত করে।ওই ব্লু বাগিং দূর থেকে কোনো ফোনের উপর হ্যাকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে কল করা বা ম্যাসেজ পাঠানো করতে পারে যা মূল ব্যবহারকারী জানতেও পারে না।একই ভাবে কারহুইস্পার নামের এই কাজ দিয়ে মূল ব্যবহারকারীর গাড়ির ভিতরের সাউন্ড সিস্টেম কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।ওই এসএমএস ইত্যাদি করে অবশ্য খুব একটা সুবিধে করা যায় না তবে বিরক্ত তো করা যায়।

@ Ajijul Shahji