আজকের এই বিশেষ বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় আমরা জানব  পালস অক্সিমিটার কীভাবে কাজ করে সেই সন্বন্ধে।

বর্তমানে আমাদের জীবনের এক নতুন সদস্য হল অক্সিমিটার । হাতের আঙ্গুল দেওয়ার সাথে সাথেই জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা। কোন রক্তপাত নেই , কোন ব্যাথাও নেই । চুপচাপ  আলো জ্বালিয়ে জানান দিচ্ছে আমাদের শরীরে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন লেবেল।

পালস অক্সিমিটার, হৃৎস্পন্দন ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র। সহজে বহনযোগ্য ছোট যন্ত্রটি কতই না কাজের। আঙুলের মাথায় লাগিয়ে জানা যায় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ। ব্যবহার করতেও নিতে হয় না বিশেষ প্রশিক্ষণ। অক্ষরজ্ঞান থাকলে সহজেই ব্যবহার করতে পারেন এই পালস অক্সিমিটার।
কিভাবে কাজ করে এই যন্ত্রটি আসুন জেনে নিই।

অন্ধকারে রাতের বেলা আমরা কিছুই দেখতে পাইনা। কিন্তু যাদের নাইট ভিশন চশমা আছে তারা একটা কিছু অবয়ব দেখতে পায়, লাল নীল সবুজ রঙের। কারন হল আমাদের শরীরের তাপমাত্রা। প্রতিটি মানুষের শরীরের উষ্ণতার ওপর নির্ভর করে একটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক র‍্যাডিয়েশন বেরোয়। ঠিক যেমন লোহাকে গরম করলে লাল হয়, তারমানে এই নয় যে লাল হবার আগে অব্দি কিছু বেরোচ্ছিল না। লাল হবার আগে অব্দি যে আলো বেরোয় সেটা আমাদের চোখ ধরতে পারে না। সেটাকে বলে ইনফ্রারেড লাইট। এই ইনফ্রারেড হল এমন আলো যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা ওয়েভলেনথ লাল আলোর থেকে বেশী। এই একই পদ্ধতিতে কাজ করে থার্মাল গান। দূর থেকে শরীরের তাপমাত্রা বলে দেয়।
অর্থাৎ খুব সোজা হিসেবে বললে দাঁড়ায়, আলোর রঙ কি হবে সেটা নির্ধারিত হয় তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে।
একে ন্যানোমিটার এককে লেখা হয়। এক ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ।  আমাদের চোখ মাত্র ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার আলো ধরতে পারে। তার বাইরে যেকোনো আলো আমরা চোখে দেখতে পাইনা। থার্মাল গানে যে ছবি দেখায়, সেটা ৭০০ এর ওপরের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। তাই ওটা কেবল ওই যন্ত্র দিয়েই দেখা সম্ভব। খালই চোখে নয়।

বেগুনী-নীল-আকাশী....বে-নী-আ-স-হ-ক-লা... মনে আছে? এর বেগুনী আলোর ওয়েভলেনথ হল ৪০০ ন্যানোমিটার মত। আর লাল এর রেঞ্জ টা ৭০০র দিকে। এই ৪০০ এর নীচের গুলোকে বলে আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী আর ৭০০ এর ওপরের গুলোকে বলে ইনফ্রারেড।
তাহলে বোঝা গেল ওয়েভলেনথ ব্যাপারটার সাথে কোনো না কোনওভাবে রঙ ব্যাপারটা জড়িত।

রক্তে, আমরা জানি অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় হিমোগ্লোবিন কণা। হিমোগ্লোবিন যদি গাড়ি হয়, অক্সিজেন হল তার প্যাসেঞ্জার। গোটা শরীরে শিরা আর ধমনীর মধ্য দিয়ে চলাচল করে। এবার রক্তে অক্সিজেন কমে যাওয়া মানে হল হিমোগ্লোবিন গাড়ী চলছে রুটে, কিন্তু প্যাসেঞ্জার নেই। এটা কিভাবে জানা যায়? উপায়টা খুব সহজ।

হ্যাঁ, এখানেই আসে ইনফ্রারেড আলোর ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন হিমোগ্লোবিন এ যদি অক্সিজেন থাকে তাহলে সেটা ৯৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশী শোষণ করে। আর যদি হিমোগ্লোবিনে অক্সিজেন  না থাকে তাহলে সেটা ৬৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশী শোষণ করে। আচ্ছা আর একটা ব্যাপার, অক্সিজেন থাকলে ৬৫০ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আবার কম শোষণ হয় আর না থাকলে ৯৫০ এর টা কম হয়।
যদি আমি দেখি, আমার রক্তে ৯৫০ বেশী শোষণ হচ্ছে ৬৫০ এর থেকে তাহলে আমার অক্সিজেন ভালো আছে। কতটা ভালো? সেটাই হিসেব করে বলে দেয় অক্সিমিটার।

এতে সাধারণত দুটো LED থাকে, একটা ৬৫০ ন্যানোমিটার আর একটা ৯৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। অন্যদিকে,  একটা ডিটেকটার থাকে যেটা দেখে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর মাত্রা কতটা কমল। আর এই দুটোর মাঝে কি থাকে?
আপনার আঙুল এর ডগা। যেখানে রক্তের পরিমাণ বেশী।
এছাড়া এক বা একাধিক চিপ থাকে এই ডেটা হিসেব করে আপনাকে স্ক্রিনে কত পার্সেন্ট হল সেটা দেখানোর জন্য।

এই প্রসঙ্গে একটু সযোজন করি ,অক্সিমিটার নকল না আসল সেটা চেনার সবচাইতে ভালো উপায় হল আঙ্গুল ঢুকিয়ে রিডিং নেবার পর আঙুলে শক্ত করে গার্ডার বেঁধে আবার চেক করুন। অক্সিজেন আঙুলে সাপ্লাই না থাকার জন্য কোন রিডিং আসবে না। কিন্তু তবুও যদি রিডিং দেখায় তাহলে বুঝতে হবে যন্ত্রটি নকল

যেহেতু এটি আলোর শোষণ ও সঞ্চারের ভিত্তিতে অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ধারণ করে । তাই হাতে নেইলপলিশ পড়া থাকলে , নেইলপলিশের মিথিলিন ব্লু এই কাজকে ব্যহত করতে পারে। ফলে পরিমাপের সময় ত্রুটি হতে পারে। তাই নেইলপলিশের ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

অক্সিমিটারের লেবেল দেখে কীভাবে বুঝব অক্সিজেনের মাত্রা ?

যদি এর লেবেল দেখায় ১০০ । তার মানে বুঝতে হবে এর ১০০ টা হিমোগ্লোবিনের মধ্যে ১০০ টাই অক্সিজেনযুক্ত ।
তবে সাধারণত এই মান ৯৮-৯৯ -এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ৯৪- এর নীচে যদি এর মান নেমে যায় তবে বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
পালস অক্সিমিটার লাগানোর আগে মিনিট পাঁচেক রিল্যাক্স অবস্থায় বিশ্রাম নিন।
হৃদপিন্ড এর লেভেলে বুকের ওপর হাত পেতে দিন।
যন্ত্রটি অন করুন/ চালু করুন বোতাম টিপে। দেখুন যন্ত্রের স্ক্রিনে ডিজিট বা সংখ্যাগুলি ভেসে উঠলো কিনা। যন্ত্রটি চালু করার পরে তার মধ্যের ইন্টারনাল ক্যালিব্রেশন সিস্টেমটি কাজ করতে শুরু করে।
হাতের মধ্যম আঙুলটি সঠিকভাবে যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিন প্রস্তুতকারক সংস্থার দেওয়া ছবি অনুযায়ী।
যন্ত্রটিকে সময় দিন যাতে সেটি পালস ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপতে পারে।
হাত, আঙ্গুল ও যন্ত্রটি কমবেশি এক মিনিট নাড়াচাড়া করবেন না। কি দেখলেন? রিডিং 99? আপনি একেবারে ঠিক আছেন, চিন্তার কারণ নেই। তাহলে আর কি?
সবাই সুস্থ্য থাকুন , পারলে এই যন্ত্রটি  কিনে বাড়িতে রাখুন। আজ তবে এ পর্যন্তই থাক। লেখা হবে নতুন কোনও বিষয়ে  আগামী সপ্তাহে। ধন্যবাদ।।