কুমোরে পোকা (potter wasp)
###########

ঘরের দেয়ালে, পতিত জমি বা বৃক্ষকাণ্ডের উপর বোলতার মতো ইতস্তত পরিভ্রমণকারী বিভিন্ন রঙের পোকা অনেকেরই নজরে পড়ে থাকবে। চলিত কথায় এগুলিকে কুমোরে-পোকা বলা হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতীয় কুমোরে-পোকার সংখ্যা কম নয়। এ-দেশীয় উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ আভাযুক্ত সোনালী রঙের পোকাগুলির প্রতিই অধিকতর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে থাকে।  যে সব কুমোরে-পোকা সচরাচর আমাদের নজরে পড়ে, তাদের অনেকেই ঘরের দেয়াল বা আনাচে-কানাচে নরম মাটির সাহায্যে বাসা তৈরি করে ;  এই জন্যেই বোধ হয় এদের নাম হয়েছে কুমোরে-পোকা। 
 বসবাস করবার জন্যে এদের বাসা বাঁধবার প্রয়োজন হয় না ; ডিম ও বাচ্চাদের জন্যেই এদের বাসার প্রয়োজন। 

 গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের 'বাংলার কীট-পতঙ্গ' লেখাটি অনেকদিন আগে পড়েছিলাম।ওখানে লেখক এই অদ্ভুত পোকাটি সম্পর্কে পর্যবেক্ষন করে বিস্তারিত লিখেছিলেন।  কুমোরে পোকার বিচিত্র সন্তানরক্ষার কৌশল। 
আপনারা হয়ত দেখেছেন কুমোরে পোকার তৈরি করে মাটির বাসাটি ভাঙলেই তা থেকে বেরিয়ে আসে
মৃত মাকড়সার দেহাবশেষ।
কিভাবে তারা সন্তানদের খাবার জোগান দেয়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য শুধু চোখেই দেখেননি, সেই দৃশ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে গেছেন।

বাসা নির্মাণের জন্যে মাটি সংগ্রহ করবার সময় উড়ে গিয়ে ভিজা মাটির উপর বসে এবং লেজ নাচাতে নাচাতে এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে দেখে । উপযুক্ত মনে হলেই সেখান থেকে ভিজা মাটি তুলে নিয়ে চোয়ালের সাহায্যে খুব ছোট্ট এক ডেলা মাটি মটরদানার মতো গোল করে মুখে করে উড়ে যায় । 
মুখ দিয়ে চেপে চেপে মাটির ডেলাটিকে দেয়ালের গায়ে অর্ধ-চক্রকারে বসিয়ে দেয়। মাটির ডেলাটাকে লম্বা করে চেপে বসাবার সময়ও তীক্ষ্ন স্বরে একটানা গুন্‌গুন্‌ শব্দ করতে থাকে। কুঠুরি তৈরি করতে প্রায় দু-দিন সময় লেগে যায় ।

আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়সার অভাব নেই ; তারা জাল বোনে না, ঘুরে ঘুরে শিকার ধরে । এই কুমোরে-পোকারা বেছে বেছে এরূপ ভ্রমণকারী মাকড়সা শিকার করে থাকে। কোনও রকমে মাকড়সা একবার চোখে পড়লেই হলো, ছুটে গিয়ে তার ঘাড় কামড়ে ধরে। কিন্তু কামড়ে ধরলেও একবারে মেরে ফেলে না । শরীরে হুল ফুটিয়ে এক রকম বিষ ঢেলে দেয় । একবার হুল ফুটিয়ে নিরস্ত হয় না । কোনও কোনও মাকড়সাকে পাঁচ-সাত বার পর্যন্ত হুল ফুটিয়ে থাকে। এর ফলে মাকড়সাটার মৃত্যু হয় না বটে, কিন্তু একেবারে অসাড়ভাবে পড়ে থাকে। তখন কুমোরে-পোকা অসাড় মাকড়সাকে মুখে করে নব-নির্মিত কুঠুরির মধ্যে উপস্থিত হয়। কুঠুরির নিম্নদেশে মাকড়সাটাকে চিৎ করে রেখে তার উদর দেশের এক পাশে লম্বাটে ধরনের একটি ডিম পাড়ে । 
কুটুরি গুলিতে এইভাবে ডিম পাড়া  সম্পূর্ণ হয়ে গেলে সে তার ইচ্ছামত যে কোনও স্থানে চলে যায়, বাসার আর কোনও খোঁজ-খবরই নেয় না। বাচ্চাদের জন্যে খাদ্য সঞ্চিত রেখেই সে খালাস।
ডিম থেকে বের হবার পর থেকেই বাচ্চাটি মাকড়সার দেহ খেতে আরম্ভ করে। একটি খাওয়া শেষ হলেই আর একটিকে খেতে আরম্ভ করে। দিন-রাত তার খাওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। খেতে খেতে প্রায় সাত-আট দিনের মধ্যেই সবগুলি মাকড়সাকে নিঃশেষ করে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে শরীরও যথেষ্ট বেড়ে উঠতে থাকে ।
বাচ্চাগুলি যাতে রোজ টাটকা খাদ্য পায় তার জন্যেই কুমোরে-পোকা শিকারগুলিকে অসাড় করে রাখবার কৌশল আয়ত্ত করে নিয়েছে।
কিছুদিন পরে বাচ্চাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপুষ্ট হলে মাটির আবরণ ছিদ্র করে বের হয়ে যায়।

সত্যি কিরকম অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা আছে এই সব পোকামাকড়দের জগতে।আমরা অনেকেই তার খবর রাখিনা, কেমন লাগল জানাবেন, আজ এই পর্যন্তই । ধন্যবাদ।